Skip to Content

মাক্কি ও মাদানি সুরা

সুরা আরবি শব্দ। আরবি ভাষায় সুরা হলো সীমান্ত রেখা বা নগরপ্রাচীর। সীমান্ত রেখা বা নগরপ্রাচীর যেমন এক এলাকা থেকে অন্য এলাকাকে পৃথক করে দেয়, তেমনি কুরআনের এক একটি পরিচ্ছেদও পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখে। এজন্য এ পরিচ্ছেদগুলোকে বলা হয় সুরা। সমগ্র কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সুরা রয়েছে। নাজিলের সময়কাল বিবেচনায় মুফাসসিরগণ (কুরআনের ব্যাখ্যা দানকারী) এ সুরাগুলোর কতগুলোকে মাক্কি সুরা এবং অবশিষ্টগুলোকে ‘মাদানি সুরা’ নামে আখ্যায়িত করেছেন।


মাক্কি সুরা কাকে বলে?

সাধারণভাবে মাক্কি সুরা হলো সেই সুরা যা মক্কায় নাজিল হয়েছে। কিন্তু মুফাসসিরগণ মাক্কি সুরার আরও ব্যাপ্তির কথা বলেছেন। তাঁরা বলেন, ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে কুরআন মাজিদের অবতরণ শুরু হওয়ার পর থেকে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদিনা হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত যে সুরাসমূহ নাজিল হয়েছে সে সুরাসমূহকেই মাক্কি সুরা বলা হবে। যদিও তা মক্কার বাইরে নাজিল হয়। সুরা নাস, ফালাক, ইখলাস, লাহাব, আসর, কাওছার, ফিল, মাউন, তীন, দুহা প্রভৃতি মাক্কি সুরার উদাহরণ। মাক্কি সুরার সংখ্যা ৮৬ টি।


মাক্কি সুরার বৈশিষ্ট্য

১. মাক্কি সুরাগুলো আকারে ছোট, আয়াতগুলোও ছোট ছোট করা হয়েছে। সাধারণভাবে 'হে মানুষ' বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

২. আয়াতের মধ্যে ছন্দ ও অন্তঃমিল রক্ষা করা হয়েছে।

৩. তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের আলোচননায় বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

৪. শিরক ও কুফর সম্পর্কে আলোচনা এবং এগুলোর অসারতা প্রমাণ করা হয়েছে।

৫. উন্নত চরিত্র গঠন এবং দৈহিক পবিত্রতার পাশাপাশি অন্তরের পবিত্রতা অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

৬. পরিচিত উপমা-উদাহরণের সাহায্যে আকাইদ ও ইমানের বিভিন্ন দিক আলােচনা করা হয়েছে।

৭. রিসালাতের প্রথম পর্যায়ের দায়িত্ব পালনের রীতিনীতি বর্ণনা করা হয়েছে।

৮. কিয়ামত বা পুনরুখানের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বর্ণিত হয়েছে।

৯. জান্নাতের সীমাহীন সুখ-শাস্তি এবং জাহান্নামের অসীম দুর্ভোগের বর্ণনা করা হয়েছে।

১০. পূর্ববর্তী কাফির ও ক্ষমতাসীন বিদ্রোহীদের ভয়ংকর পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে।

১১. আল-কুরআনের সত্যতা প্রমাণের সাথে সাথে অন্যান্য আসমানি কিতাবের সত্যায়ন প্রমাণিত হয়েছে।

১২. আখিরাতের বিচারব্যবস্থা, হিসাবনিকাশ ও শেষ পরিণতির হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

১৩. প্রতিটি সুরাতেই বিভিন্ন বিষয়ের শপথ করার মাধ্যমে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা রয়েছে।

১৪. সিজদার আয়াতের সাধারণ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

১৫. মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছে।

১৬. মুশরিক ও কাফিরদের (অবাধ্য) নানা প্রশ্ন এবং তার পরিশীলিত জবাব দেওয়া হয়েছে।

১৭. হে মানুষ, হে আদম সন্তান,  (হে কাফিররা), (কখনো নয়) প্রভৃতি শব্দের সাধারণ প্রয়োগ মাক্কি সুরাসমূহকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।


মাদানি সুরা কাকে বলে?

সাধারণভাবে মদিনায় নাজিলকৃত সুরাসমূহকে মাদানি সুরা বলা হয়। অবশ্য মুফাসসিরগণ যেসব সুরা ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদিনায় হিজরতের পর নাজিল হয়েছে সেগুলোকে মাদানি সুরা হিসেবে অভিহিত করেছেন; যদিও এ সুরা বা সুরার কোনো আয়াত মদিনার বাইরে নাজিল হয়। যেমন- সুরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াত মক্কায় বিদায় হজের সফরে নাজিল হয়েছে। তা সত্ত্বেও নাজিলের সময় বিবেচনায় এটি মাদানি সুরার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুরা বাকারা, আলে ইমরান, নিসা, মায়িদা, আনফাল, আনআম প্রভৃতি মাদানি সুরার দৃষ্টান্ত।


মাদানি সুরার বৈশিষ্ট্য

১. মাদানি সুরাগুলো আকারে দীর্ঘ, আয়াতগুলোও বড় বড়।

২. (হে মুমিনগণ!) দিয়ে সাধারণ সম্বাধন।

৩. সুরার মধ্যে গদ্যরীতির অনুসরণ। ছন্দ ও অন্তঃমিল রক্ষার চেয়ে বিষয় বর্ণনার ওপর অধিক গুরুত্বারােপ।

৪. সৃষ্টিতত্ত্বের বাস্তবরূপ ও ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা।

৫. অতীত জাতির জীবনাচার, অবাধ্যতা ও পরিণতির বিস্তারিত বিবরণ।

৬. ইমান ও আকিদাগত বিষয়ের পাশাপাশি ইবাদতের ওপর গুরুত্বারােপ।

৭. আহকামে শরিয়া, হালাল-হারাম ও ইসলামি রীতিনীতির বিশদ বর্ণনা।

৮. ইসলামের ব্যাবহারিক আইন, বিবাহ, ক্রয়-বিক্রয় ও সামাজিক মেলামেশার রীতিপদ্ধতি বর্ণনা।

৯. ইসলামের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নীতি, আদর্শ, পদ্ধতি ও ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ।

১০. লেনদেন, উত্তরাধিকার আইন, যুদ্ধরীতি, জিহাদ, প্রচার প্রভৃতির রীতি-পদ্ধতি বর্ণনা।

১১. মুশরিক, কাফির, ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং বিশেষ করে মুনাফিকদের জীবনাচার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের আলোচনা এবং তাদের মিথ্যা দাবি ও যুক্তির অসারতা প্রমাণ।

১২. মুনাফিক ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও ঘৃণ্য মানসিকতার মুখোশ উন্মোচন।

১৩. মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকের সাথে মুসলিমদের আচরণবিধি ও তাদের অধিকার বর্ণনা।


মাক্কী ও মাদানি সূরার সংখ্যা : মোট ১১৪টি সূরার মধ্যে ১৭টি সূরা সম্পর্কে মতভেদ দেখা যায়। এর মধ্যে ৫টি সূরা নিয়ে ব্যাপক মতভেদ আছে। বাকী ১২টির মধ্যে অধিকাংশের মতে ৪টি মাদানী ও ৮টি মাক্কী।

১. যে ৫টি সূরা সম্পর্কে ব্যাপক মতভেদ আছে — আল বাইয়েনাহ (৯৮), আল আদিয়াহ (১০০), আল মাউন (১০৭), আল ফালাক (১১৩) ও আন নাস (১১৪)।

২. অধিকাংশের মতে যে ৪টি সূরা মাদানী- রাদ (১৩), রাহমান (৫৫), দাহর (৭৬) ও যিলযাল (৯৯)।

৩. অধিকাংশের মতে যে ৮টি সূরা মাক্কী- আত- তীন (৯৫), আল কদর (৯৭), আত- তাকাসুর (১০২), আল- আসর (১০৩), আল কুরাইশ (১০৬), আল কাউসার (১০৮), আল কাফিরুন (১০৯) ও আল ইখলাস (১১২)।

অধিকাংশের মতে, ২৮টি মাদানী সূরা এবং ৮৬টি মাক্কী সূরা।

কুরআনের শেষ দু পারায় অধিকাংশ মাক্কী সূরা রয়েছে। ২৯ পরার ১১টি সূরার সবই মাক্কী এবং আমপারার ৩৭ টির মধ্যে ৩৪টিই মাক্কী। মোট ৮৯টি মাক্কী সূরার ৪৫টি শেষ দু পারায় এবং বাকী ৪৪টি সমগ্র কুরআনে ছড়িয়ে আছে।

কতক সূরার প্রথম ভাগ মাক্কী হওয়ায় পরবর্তী অংশ মাদানী হওয়া সত্ত্বেও মাক্কী হিসেবে পরিচিত। যেমন সূরা মুযযাম্মিল।

Administrator March 27, 2025
Share this post
Tags
Archive
মুমিনের রাত্রি যাপন